পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের তরফে সমগ্র রাজ্যের দরিদ্র, অর্থনৈতিকভাবে অসহায় ক্ষেত্রের জনগণের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প, যোজনা লঞ্চ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে দরিদ্র, অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে কার্যকরী সমস্ত প্রকার প্রকল্প এবং যোজনার মধ্যে রাজ্যের সাধারণ জনগণের মধ্যে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা প্রকল্পটি বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। সমগ্র রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বসবাসকারী নির্মাণকর্মী, পরিবহণ কর্মী সহ অন্যান্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের উন্নয়ন, রোগ নিরাময় এবং আরোগ্য লাভ, সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে আর্থিক অসংগতির কথা মাথায় রেখে রাজ্য সরকারের তরফে এই সামাজিক সুরক্ষা যোজনা কার্যকর করা হয়েছে।
সামাজিক সুরক্ষা যোজনার অধীনে থাকা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের আয় সুনিশ্চিত করাই এই যোজনার উদ্দেশ্য। ২০২৩ সাল অর্থাৎ চলতি বছরের শুরুতেই রাজ্য সরকারের তরফে যে দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প আয়োজন করা হয়েছিল তাতে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল এই সামাজিক সুরক্ষা যোজনা।
কারা সামাজিক সুরক্ষা যোজনার আওতায় আবেদন জানাতে পারবেন:-
১. রাজ্য সরকারের তরফে জারি করা তথ্য অনুসারে সামাজিক সুরক্ষা যোজনায় নিজের নাম নথিভুক্ত করার ক্ষেত্রে আবেদনকারী ব্যক্তিকে অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।
২. সমগ্র রাজ্যের বিভিন্ন ধরনের অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের জন্যই এই বিশেষ প্রকল্প কার্যকর করা হয়েছে। অর্থাৎ এই সমস্ত শ্রমিকরাই শুধুমাত্র সামাজিক সুরক্ষা যোজনা আওতায় নিজেদের নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন।
৩. কেবলমাত্র ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী নাগরিকরাই এই সামাজিক সুরক্ষা যোজনার আওতায় নিজেদের নাম নথিভুক্ত করার ক্ষেত্রে যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
৪. সামাজিক সুরক্ষা যোজনার আওতায় আবেদনের ক্ষেত্রে আবেদনকারী ব্যক্তির পরিবারের মাসিক আয় ৬৫০০ টাকার তুলনায় কম হতে হবে। তবে রাজ্য সরকারের প্রকাশিত তথ্যে জানানো হয়েছে যে, রাজ্যের নির্মাণ কর্মী এবং পরিবহণ কর্মীদের আবেদনের ক্ষেত্রে পরিবারের মাসিক আয়ের উর্ধ্বসীমা গণনা করা হবে না। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী নির্মাণ কর্মী ও পরিবহণ কর্মীদের আবেদনের ক্ষেত্রে আয়ের উর্ধ্বসীমা নেই।
সামাজিক সুরক্ষা যোজনা অধীনে কি কি সুবিধা মিলবে?
অসংরক্ষিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সামাজিক সুরক্ষা যোজনার আওতায় ভবিষ্যত নিধি প্রকল্প কার্যকর করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা যোজনার আওতায় থাকা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থ পেয়ে থাকেন। তবে ভবিষ্যত নিধি প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা যোজনার আওতায় থাকা শ্রমিকদের প্রতি মাসে নিজস্ব অ্যাকাউন্টে ২৫ টাকা করে জমা করতে হয়। রাজ্য সরকারের তরফে উক্ত শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টে আরো ৩০ টাকা করে দেওয়া হয়ে থাকে। উপভোক্তার ৬০ বছর বয়স হওয়ার পর এককালীন ২ লক্ষ টাকার সহায়তা পেয়ে থাকেন এই প্রকল্পের আওতাধীন ব্যক্তিরা। অন্যদিকে এই যোজনার আওতাধীন ব্যক্তিদের সাধারণ চিকিৎসার জন্য ২০,০০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে এবং শৈল চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৬০,০০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে।
এর পাশাপাশি রাজ্য সরকারের তরফে আরো জানানো হয়েছে যে, দুর্ঘটনার কারণে কোন কর্মীর কাজ করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেলে উক্ত কর্মীকে সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকার অনুদান দেওয়া হবে। এছাড়াও সামাজিক সুরক্ষা যোজনের আওতায় থাকা ব্যক্তিদের দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যু ঘটলে সর্বোচ্চ ২,০০,০০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে, অন্যদিকে এই সমস্ত ব্যক্তিদের স্বাভাবিক কারণে মৃত্যু ঘটলে সর্বোচ্চ ৫০,০০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। দুর্ঘটনার কারণে কোন শ্রমিকের দুটি চোখের দৃষ্টি চলে গেলে অথবা কোনো ব্যক্তি যদি তার দুটি হাত কিংবা দুটি পা কোনো দুর্ঘটনার কারণে হারিয়ে ফেলে, তবে ওই ব্যক্তিকে ২,০০,০০০ টাকার অর্থ সাহায্য দেওয়া হবে। অন্যদিকে দুর্ঘটনাজনিত কারণে যদি কোন ব্যক্তি তার একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি অথবা একটি হাত কিংবা একটি পা হারিয়ে থাকেন তবে ওই ব্যক্তিকে ১,০০,০০০ টাকার অর্থ সাহায্য দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি রাজ্য সরকারের তরফে আরো জানানো হয়েছে যে, ৪০ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৫০,০০০ টাকার অনুদান দেওয়া হবে।
এখানেই শেষ নয়, সামাজিক সুরক্ষা যোজনার আওতাধীন ব্যক্তিরা সন্তানের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তারও এই প্রকল্পের মাধ্যমে পেয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে একাদশ শ্রেণিতে পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ৪০০০ টাকা, দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ৫০০০ টাকা, ITI -এর অধীনে পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রতিবছরে ৬,০০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। স্নাতক স্তরে পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বাৎসরিক ৬,০০০ টাকার অনুদান, স্নাতকোত্তর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বাৎসরিক ১০,০০০ টাকার অনুদান এবং পলিটেকনিকে পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বাৎসরিক ১০,০০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা আওতায় থাকা ব্যক্তিদের। এছাড়াও যে সমস্ত ব্যক্তিদের সন্তান মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং -এর মত প্রফেশনাল কোর্সে পাঠরত তাদের বাৎসরিক ৩০,০০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা যোজনার আওতাধীন ব্যক্তিদের দুটি কন্যা সন্তানের শিক্ষা সম্পন্ন করার জন্য আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে, এক্ষেত্রে প্রত্যেক কন্যা সন্তানকে ২৫,০০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন:- লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে চান? রইলো সহজ পদ্ধতি।
সামাজিক সুরক্ষা যোজনা আওতায় নাম নথিভুক্ত করার জন্য আবেদন জানাবেন কিভাবে?
১. সামাজিক সুরক্ষা যোজনা আওতায় আবেদনের ক্ষেত্রে আপনাকে প্রথমে রাজ্য সরকারের তরফে কার্যকরী সামাজিক সুরক্ষা যোজনা অফিসিয়াল ওয়েবসাইট https://bmssy.wblabour.gov.in/ -এ যেতে হবে। এরপর হোম পেজে থাকা New Registration by Beneficiary অপশনে ক্লিক করুন।
২. উপরোক্ত অপশনে ক্লিক করলে আপনার সামনে রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ফর্মটি চলে আসবে। এই ফর্মে আপনি কি ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত, আপনার নাম, জন্ম তারিখ, ইমেইল এড্রেস, মোবাইল নম্বর, কাস্ট, আধার নম্বর, খাদ্যসাথী নম্বর, বৈবাহিক স্থিতি, পিতার নাম, মায়ের নাম, পরিবারের বাৎসরিক আয়, জেলা, সাব ডিভিশন, রাজ্য, ব্লক, গ্রাম পঞ্চায়েত, পিনকোড, পোস্ট অফিস সহ আপনার ঠিকানা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য সঠিকভাবে প্রদান করে Register অপশনে ক্লিক করতে হবে।
৩. রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে আপনাকে একটি User Name এবং পাসওয়ার্ড দেওয়া হবে যার মাধ্যমে আপনাকে Login -এর প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে হবে। এরপর আপনার সামনে যে পেজটি আসবে তাতে আপনি আপনার সমস্ত তথ্য দেখতে পারবেন, ওই পেজের বাঁদিকে থাকা Update CAF অপশনে ক্লিক করুন।
৪. উপরোক্ত অপশনে ক্লিক করলেই আপনার সামনে আপনার Basic Information চলে আসবে। আপনি যদি আপনার কর্মক্ষেত্রে প্রভিডেন্ট ফান্ডের আওতায় থেকে থাকেন তবে এই পেজের নিজের দিকে থাকা Yes অপশনে ক্লিক করুন এবং তা যদি না হয় তবে এই পেজটি নিচের দিকে থাকা No অপশনে ক্লিক করুন। এই পেজে উল্লিখিত আপনার সমস্ত তথ্য ঠিক থাকলে Save Draft and Proceed অপশনে ক্লিক করুন।
৫. এরপর আপনার সামনে আপনার ঠিকানা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য চলে আসবে। এক্ষেত্রে সমস্ত তথ্য ঠিক থাকলে পুনরায় Save Draft and Proceed অপশনে ক্লিক করবেন। পরবর্তীতে আপনাকে আপনার ব্যাংকের নাম, ব্যাংকের ব্রাঞ্চের নাম, অ্যাকাউন্ট নম্বর, IFSC কোড, ব্যাংকের লোকেশন, কোন ডিস্ট্রিকে ব্যাংকের ব্রাঞ্চ রয়েছে তা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য প্রদান করতে হবে এবং উক্ত পেজের নিচের দিকে থাকা Save Draft and Proceed অপশনে ক্লিক করতে হবে।
৬. পরবর্তীতে আপনার সামনে যে পেজটি আসবে তাতে আপনাকে আপনার নমিনির নাম, আপনার সঙ্গে নমিনীর সম্পর্ক, নমিনীর বয়স, জন্ম তারিখ সহ উক্ত ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সমস্ত তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করতে হবে। সমস্ত তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করা হলে Save Draft and Proceed অপশনে ক্লিক করুন এবং এগিয়ে যান।
৭. এরপর আপনার সামনে যে পেজটি আসবে তাতে আপনার পরিবারের কতজন সদস্য আপনার ওপর নির্ভর করে রয়েছেন তাদের একটি তালিকা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনার ওপর নির্ভরশীল সদস্যদের নাম, জেন্ডার, বয়স, জন্ম তারিখ এবং আপনার সঙ্গে উক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্ক সঠিকভাবে উল্লেখ করতে হবে এবং পেজটির নিচে থাকা Save Draft and Proceed অপশনে ক্লিক করতে হবে।
৮. উপরোক্ত অপশনে ক্লিক করলে আপনার সামনে যে পেজটি আসবে সেই পেজটিতে আবেদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সমস্ত প্রকার নথি আপলোড করতে হবে। নথি আপলোড করার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে উক্ত পেজের ডান দিকে থাকা Final Review অপশনে ক্লিক করুন।
৯. Final Review অপশনে ক্লিক করলেই আপনার সামনে সমগ্র ফর্মটি রিভিউ চলে আসবে সমস্ত তথ্য ঠিক থাকলে পেজটি নিচের দিকে থাকা চেকবক্সে ক্লিক করে Final Submit অপশনে ক্লিক করুন।
১০. এরপর আপনার সামনে যে পেজটি আসবে তাতে থাকা Download Form 1 অপশনে ক্লিক করে আপনাকে Form 1 ডাউনলোড করে নিতে হবে এবং ফর্মটি প্রিন্ট করে নিতে হবে। তারপর প্রয়োজনীয় সমস্ত ক্ষেত্রে আপনাকে সঠিকভাবে স্বাক্ষর করতে হবে এবং শেষে উল্লেখিত সার্টিফিকেটে আপনার এলাকার MLA, MP, পঞ্চায়েত প্রধান, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান -এর মত বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষর প্রয়োজন হবে।
১১. পরবর্তীতে আপনাকে এই ফর্মটিকে সামাজিক সুরক্ষা যোজনার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে তাহলেই আবেদনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়ে যাবে।
আবেদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নথি:-
১. আবেদনকারীর আধার কার্ড
২. ভোটার কার্ড
৩. রেশন কার্ড
৪. ব্যাংকের পাস বই
৫. পরিবারের বার্ষিক আয়ের সার্টিফিকেট।
৬. আবেদনকারীর পাসপোর্ট সাইজের ফটোগ্রাফ।
৭. আবেদনকারীর পরিবারের সদস্যদের নাম এবং পরিচয় পত্র।